৪ মাস পর খুলল ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ

৪ মাস পর খুলল ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ

এনামুল হক রেনু ॥  সংস্কারের জন্য প্রায় চার মাস বন্ধ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে পথচারী ও হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ খুলে দেয়া হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্রিজ খুলে দেয়া হলেও মূলত বুধবার সন্ধ্যা থেকে পথচারীরা সেতু দিয়ে পারাপার শুরু করেন। এরপর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলাচলও শুরু হয়। কিন্তু এখন থেকে হেঁটে পারাপারের পাশাপাশি শুধুমাত্র রিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হবে বলে জানিয়েছে কিনব্রিজের তদারককারী প্রতিষ্ঠান সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর(সওজ)। এ লক্ষ্যে সেতুর দুই পাশে খুঁটি বসিয়ে ভারী যানবাহন চলাচলের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে।

নগরীর বাসিন্দারা জানান, সিলেট নগরীর মধ্যবর্তী স্থানে কিনব্রিজের অবস্থানের কারণে স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা সুরমা নদী পারাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকেন। চার মাস ধরে কিনব্রিজ মেরামত কাজের জন্য বন্ধ থাকায় সিলেটের উত্তর-দক্ষিণ অংশের বাসিন্দাদের যাতায়াতে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। যারা ব্রিজ দিয়ে হেঁটে সুরমা নদী পার হতেন; তাদের বিকল্প হিসেবে খেয়া নৌকায় পারাপার হতে হয়। ছোট নৌকায় ধারণক্ষমতা ১০/১৫ জন, অথচ এর তিন গুণ মানুষ উঠিয়ে জনপ্রতি ৫ টাকা ভাড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছিলেন তারা। তাছাড়া নগরীর অভ্যন্তরে থাকা শাহজালাল ব্রিজ ও কাজীরবাজার সেতু ব্যবহার করেন পথচারীরা। তবে, সেই দুটি সেতু শহরের দুই পাশে হওয়ায় ভোগান্তি বেশি পোহাতে হয়েছে। কিনব্রিজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে সুরমা নদীর দুই পাশের বাসিন্দাদের।

নগরীর বন্দরবাজার এলাকার ব্যবসায়ী ও ভার্থখলা এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্রিজটি বন্ধ থাকায় আমাদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল। দুর্ঘটনার শঙ্কা নিয়ে খেয়া নৌকা দিয়ে আমরা সুরমা নদী পার হয়েছি। এখন উন্মুক্ত হওয়ায় চলাচলে সুবিধা হলো।
সওজ সিলেট’র নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, সংস্কার শেষে আবারও জনসাধারণের জন্য এটি খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে, সেতুটি পুরোনো হওয়ায় যাতে এখন থেকে ভারী যানবাহন চলাচল করতে না পারে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পথচারীরা হেঁটে পারাপারের পাশাপাশি রিকশা, মোটরসাইকেল চলাচলের ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ভারী কোনো যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না।

সওজ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৩৬ সালে নির্মিত ১ হাজার ১৫০ ফুট দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রস্থের লোহার  তৈরি জরাজীর্ণ কিনব্রিজ সংস্কারের বিষয়ে ২০২০ সালে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হয়। সেখানে সেতু সংস্কারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিন সদস্যের একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সওজের পক্ষ থেকে ব্রিজটি সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় সওজ। একই বছরের জুন মাসে বরাদ্দকৃত টাকা রেলওয়ের সেতু বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে নানা জটিলতায় সংস্কার কাজ বিলম্বিত হচ্ছিল। অবশেষে গত ১৬ আগস্ট প্রথম দফায় দুই মাসের জন্য কিনব্রিজ দিয়ে চলাচল বন্ধ করে সংস্কার কাজ শুরু হয়। তারপর দুই দফা পিছিয়ে সংস্কারকাজ শেষ হয় ১৫ ডিসেম্বর। এরপরও ব্রিজটি উন্মুক্ত করা হচ্ছিল না। এরপর গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভা শেষে পথচারীরা নির্মাণসামগ্রী ও ব্রিজের দুই পাশে পথ রোধ করে রাখা টিনের বেড়া অপসারণ করে পারাপার শুরু করেন। পরে রাত থেকে হেঁটে চলার পাশাপাশি সব ধরনের যান চলাচল শুরু হলে সকালে ব্রিজটি উন্মুক্তের ঘোষণা দেয়া হয়।

ব্রিটিশ আমলে তৈরি লোহার কাঠামোর দৃষ্টিনন্দন ‘কিন ব্রিজ’ নির্মাণ করেছিল রেলওয়ে বিভাগ। টানা দুই বছর নির্মাণকাজ শেষে ১৯৩৬ সালে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন অসম (বর্তমান আসাম) প্রদেশের ব্রিটিশ গভর্নর মাইকেল কিনের নামে এই সেতুর নামকরণ করা হয় ‘কিন ব্রিজ’। নির্মাণের পরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেতুটি। পরে ১৯৭৭ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রথম দফা সংস্কার করেছিল। তাছাড়া বছর চার আগে সিটি কর্পোরেশন ব্রিজটির কার্পেটিংসহ সোডিয়াম বাতি লাগালেও মূল কাঠামোতে তেমন সংস্কার হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটির দুই দিকে লোহার বেষ্টনী দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে সিটি কর্পোরেশন। তবে নাগরিকদের প্রতিবাদের মুখে বন্ধের কিছুদিন পরেই যান চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হয়।